
দহেন বিকাশ ত্রিপুরা, স্টাফ রিপোর্টার, খাগড়াছড়ি||
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত জেরক পাড়া ও হেমন পাড়ায় সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে যে চিত্র সামনে আসে, তা যে কোনো উন্নয়নকামী রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পারে। জেলা সদরের মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দুই গ্রাম আজও রয়ে গেছে ভয়ংকর দুর্গমতার মাঝে—যেখানে প্রতিদিনের জীবনযাপনই এক ধরনের সংগ্রাম।
জেরক পাড়া ও হেমন পাড়ায় যেতে খাগড়াছড়ি–দীঘিনালা সড়ক ধরে ৭ মাইল পর্যন্ত যেকোনো গাড়ি চললেও এরপর শুরু হয় ধকল। প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা, তারপর একশ ফুট উঁচু খাড়া পাহাড় বেয়ে নামা, এরপর ত্রিমুখী ছড়া, যা বর্ষায় রূপ নেয় মৃত্যুফাঁদে।
তারপর আবার খাড়া পাহাড়ে ওঠা—শেষ নেই এই কষ্টের।
স্থানীয়দের ভাষায়, শরীর সুস্থ আর দেহ সুঠাম না হলে এই রাস্তায় যাতায়াত করা অসম্ভব। নতুন মানুষ হলে গ্রামে পৌঁছতে সময় লাগে ৪–৫ ঘণ্টা।
এই অমানবিক পথ পেরিয়েই প্রতিদিন স্কুলে যায় জেরক ও হেমন পাড়ার শিক্ষার্থীরা। রথিচন্দ্র পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অঞ্জলি ত্রিপুরা বলেন—রাস্তাঘাট ও নিরাপদ পানি—এই দুটো সমস্যাই সবচেয়ে বড়। সমাধান না হলে শিক্ষা মানোন্নয়ন অসম্ভব।
প্রধান শিক্ষক শিক্ষক ধনীময় ত্রিপুরা যোগ করেন-শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মূল বাধাই হলো রাস্তাঘাট ও পানির সংকট।
বর্ষার কঠিন সময় বিবেচনায় কয়েক বছর আগে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে একটি কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়। কার্বারী খোকন ত্রিপুরা বলেন— “ধন্যবাদ জেলা পরিষদকে, কিন্তু কাঠের ব্রীজ স্থায়ী নয়—যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। স্থায়ী ব্রীজই আমাদের বাঁচাতে পারে।”
বর্তমান রাস্তা বর্ষার পানির স্রোতে এতটাই নষ্ট হয়ে গেছে যে বাজারের দিনেও গাড়ি যায় না। জেরক পাড়ার প্রতিনিধি নীরাময় ত্রিপুরা জানান—পাহাড়ি কলা বা জুমের ফসল বাজারে আনতে কখনো ভাড়াই পড়ে বেশি, কখনো কাঁধে বোঝা করে আনতে হয়। ফলে বাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।” এটি স্থানীয়দের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
জেরক পাড়া ও হেমন পাড়ায় ৪৪টির বেশি পরিবার বসবাস করে। তাদের সবচেয়ে বড় মানবিক সমস্যা—নিরাপদ পানি নেই।
স্থানীয় সচেতন চরন দেবী ত্রিপুরা বলেন, পরিষ্কার পানির অভাবে প্রতিদিনই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।”
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সমাপন ত্রিপুরা ও রাম কুমার ত্রিপুরা আশ্বস্ত করেছেন—“ইউনিয়ন পরিষদের বিশেষ প্রকল্প বা জেলা পরিষদ–উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নিরাপদ পানি ও একটি যুব ক্লাব–লাইব্রেরি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।”
হেমন পাড়ার কার্বারী খোকন ত্রিপুরার কণ্ঠে তীব্র বেদনা— “আমরা কি এতো দূর্গম এলাকায় জন্মেছি বলেই পিছিয়ে থাকব? যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক হলে আমরা অন্তত আরেকটু এগোতে পারতাম।” তাদের বিশেষ দাবি: স্থায়ী সেতু নির্মাণ; খাড়া পাহাড়ে ইট-পাথরের সিড়ি; ৮ মাইল-জেরক ও হেমন পাড়া গ্রাম্য সড়কে দ্রুত সংস্কার বা পিচঢালাই, নিরাপদ পানির স্থায়ী সমাধান।
অবহেলা নয়—জেরক ও হেমন পাড়ার মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে অবিলম্বে উদ্যোগ প্রয়োজন। জেরক ও হেমন পাড়ার গল্প কেবল একটি গ্রামের গল্প নয়—এটি বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বহু গ্রামের বাস্তবতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি ও শিক্ষা–স্বাস্থ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ ছাড়া এসব মানুষ আরও কতদিন উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থাকবে?