
॥মোঃ নুরুল আমিন, স্টাফ রিপোর্টার, রাঙ্গামাটি॥
আজ থেকে ঠিক ২৮ বছর আগে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’। দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্য ছিল এই চুক্তির। তবে ২৮ বছর পূর্তির এই দিনেও পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই শান্তি অধরাই রয়ে গেছে। চুক্তির মৌলিক বিধানগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিদ্যমান এবং থামেনি রক্তক্ষয়ী সংঘাত।
শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে নতুন করে আরও ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরাই চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত পাহাড়ের জনজীবনকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে গত কয়েক বছরে কয়েকশ হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতাও দেখা গেছে। যেমন, ২০২৪ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত ১৯শে সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। দ্রুত তা পার্শ্ববর্তী জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়ে। এতে খাগড়াছড়িতে তিন, রাঙ্গামাটিতে একজনের মৃত্যুর সাথে ৫০ জনের বেশি আহত এবং প্রায় ১০২টি দোকানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, চুক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনও অবাস্তবায়িত রয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, যেটির ওপর পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধানের মূল দায়িত্ব ছিল, তা এখনও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেনি। হাজার হাজার ভূমি বিরোধের অভিযোগ ফাইলবন্দী হয়ে আছে।
তবে সরকার পক্ষ বরাবরই দাবি করে আসছে যে, চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতে, সরকার এই চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে পুনর্গঠন করেছে এবং ভূমি কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে, যদিও দৃশ্যমান বড় কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি।
অন্যদিকে,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং অন্যান্য উপজাতি সংগঠনগুলোর অভিযোগ, চুক্তির মূল বিষয়গুলো, যেমন-পার্বত্য এলাকাকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিশেষ প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেওয়া, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষমতা হস্তান্তর, এবং সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার এগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং বাঙালি বসতি স্থাপনকারী ও স্থানীয় পাহাড়িদের মধ্যকার অবিশ্বাস ও ভূমি নিয়ে বিরোধ শান্তি প্রক্রিয়ার প্রধান বাধা। এছাড়া, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নতুন করে সৃষ্ট সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতাও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেছে। পূর্ণাঙ্গ শান্তি বাস্তবায়নের জন্য ভূমি কমিশনকে দ্রুত কার্যকর করা, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া এবং সব পক্ষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, বর্তমানে পাহাড়ে ছয়টি আঞ্চলিক দল বিভিন্ন উপজেলা দখল করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দলগুলো হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (লারমা সংস্কার গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ (সংস্কার গ্রুপ), কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), ও মগ লিবারেল ফ্রন্ট। তবে চুক্তির পর দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সমাপ্ত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই ছয়টি দলের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। ছয়টি আঞ্চলিক সংগঠন নিজেদের মধ্যে হানাহানি অব্যাহত রেখেছে। তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে চলছে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা।
একটি হিসাবমতে, শান্তিচুক্তি পরবর্তী ২৮ বছরের আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্ধে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ৬ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে। এই সংখ্যায় প্রাণ দিতে হয়েছে বহু আওয়ামী পাহাড়ি নেতাকর্মীকে। হিসাবমতে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বছরে চাঁদার আদায়ের পরিমান প্রায় ৪শত কোটি টাকা। ঠিকাদারী থেকে শুরু করে চাকরীজীবি, পেশাজীবি, কৃষক, জেলে, খামারী সবার থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় তাদের। চাঁদাবাজি ও স্বশস্ত্র হামলার অভিযোগে প্রায়শঃ যৌথবাহিনীর অভিযানে ব্যাপকহারে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
চুক্তির ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে এখনো পুরোপুরি শান্তি ফেরেনি। এখনো ঘটছে গোলাগুলি, রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পাহাড়ে বিভিন্ন দল ছেড়ে নতুন নতুন দল-উপদল তৈরির মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এসব দলের মধ্যে একে অপরের সাথে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও জাতিগত ভেদাভেদ লেগেই থাকে। এ অবস্থায় পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানোর দাবি তুলেছেন সচেতন মহল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মুজিবর রহমান জানান, চুক্তির ২৮ বছরের কোনো বৈষম্য দূর হয় নাই এবং পাহাড়ে কোনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এই চুক্তিটি আসলেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হয় নাই,এই চুক্তিটি হলো ১৩ হাজার বর্গকিলিমিটারের বিশাল অঞ্চল নোয়াখালী,কুমিল্লার কিছু অংশ এবং কক্সবাজারকে সহ নিয়ে ত্রিপুরার অংশ করতে চাই। মূলত এই চুক্তিটি হলো এ অঞ্চলকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার একটি দলিল এবং এই চুক্তি আমরা বাতিল চাচ্ছি। কারণ, এই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয়,তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বলতে কিছু থাকবে না এবং সংবিধান বলতে আর কিছু থাকবে না। সুতারাং, এই চুক্তিটি একটি জনগণ বিরোধী চুক্তি। তিনি আরো জানান, চুক্তিটির শুরুতেই ৫৪% বাঙালিকে ভোঁতা চুরি দিয়ে জবাই করা হয়েছে। আর যারা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রায় একশ বছর আগে এসে এখানে বসবাস করছে তাদেরকে অনেক উপরে তুলে দেয়া হয়েছে। সুতারাং এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া মানে ভারতের হাতে এই অঞ্চলকে তুলে দেয়। আমরা চাই-এই চুক্তি বাতিল হউক।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক অনুপম বড়ুয়া শংকর জানান,পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৮ বছর পূর্তি,এখনও শান্তিচুক্তি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে,তা বোধগম্য নয় এবং আদ্যে কি বাস্তবায়ন হবে কি না এটি সরকারের উপর নির্ভর করছে। তবে চুক্তির মৌলিক বিধানগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা দাবি করেন তিনি। তিনি আরো জানান, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নিরসন করতে হবে,তাহলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিবিরোধ কমিশন নিষ্ক্রিয়কে সক্রিয় করা এবং জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন গণতান্ত্রিকভাবে জাতীয় নির্বাচনের পরে এইসব পরিষদের নির্বাচন দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্ববধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অদিষ্টিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। তাই ২৮ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমাদের দেশের আপামর জনগণকে এবং বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার ও পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে উদার আহ্বান জানাচ্ছি ,উদার মন নিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে আজ শান্তিচুক্তির ২৮ বছর উপলক্ষে গণসমাবেশ করছেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে এ সমাবেশ চলছে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের তখনকার চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।