মো. আবুল হাসেম, মাটিরাঙ্গা প্রতিনিধি:
শীতের সকাল মানেই খেজুর রসের গন্ধ। ভোররাতে শিশিরভেজা উঠোন, চুলোর ধোঁয়া আর নতুন চালের পিঠার মিষ্টি গন্ধে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষের। এরপর পিঁড়ি পেতে বসে কাঁচা রস কিংবা ঘন রসে ডুবানো পিঠা শীতকালের এই দৃশ্য যেন গ্রামবাংলার এক অমূল্য স্মৃতি।
কিন্তু সেই স্মৃতির ছবি যেন কিছুটা বদলে গেছে। মাটির হাঁড়ির জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের বড় বড় বোতল। প্রশ্ন উঠছে রসের আসল স্বাদ কি আগের মতো থাকে? আর নিরাপত্তার জায়গাটা? খেজুর রস কি সত্যিই প্লাস্টিক বোতলে নিরাপদ?
মাটিরাঙ্গার নতুন পাড়া এলাকায় শেষ বিকেলে এমন দৃশ্যে দেখে মিলে। সোনালী রঙের আলতো রোধ এসে পড়ছে খেজুর গাছের গায়ে। গাছের উপরিভাগ থেকে গড়িয়ে পড়া রসের ‘টুপটাপ’ শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে গাছের গায়ে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি বদলে ঝুলছে কাটা মুখের প্লাস্টিক বোতল। খায়ের মিয়ার বাড়ির পাশে এক সারি খেজুরগাছে একই দৃশ্য।
আবুল খায়ের বললেন, “হাঁড়ি টেকে না। দামও বেশি। আবার অনেকে দূর থেকে ইট ছুড়ে ভেঙে দেয়। তাই বাধ্য হয়েই বোতল ব্যবহার করছি।” তার কথায় বাস্তবতার টান আছে। প্লাস্টিক সহজলভ্য, বহনও সুবিধাজনক। কিন্তু সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে উদ্বেগও। তবে খেজুরের রস সংগ্রহের পাত্র নিয়ে এত বাগবিতণ্ডা, যদি খেজুরের গাছই না থাকে তাহলে পাত্র দিয়েই বা কি হবে? দিনদিন খেজুরগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে কেউ গাছ লাগাচ্ছেন না। দামও বেড়েছে অঞ্চলভেদে প্রতি কেজি খেজুরের কাঁচা রস ৪০-৫০ টাকা, যেখানে এক সময় কেজি প্রতি ৫ টাকায় বিক্রি হতো। আর ঘন রসের প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকায়।
মাটিরাঙ্গার গোমতীতে সারিবদ্ধ কিছু খেজুরগাছ দেখা যায়। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন স্থানের বসতবাড়িতে দু-একটি খেজুরগাছ রয়েছে। আর বড়নাল ইউনিয়নের মাষ্টারপাড়ায় সারিসারি কিছু খেজুরগাছ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যখন নতুন প্রজন্মকে খেজুরগাছ চিনিয়ে দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে।
স্থানীয় রসপ্রেমী জামাল হোসেনের মনে যেন সেই হারানো স্বাদের হাহাকার “হাঁড়ির রসের মতো সুবাস আর পাই না। বোতলের রসে যেন একটা অচেনা গন্ধ থাকে।”
রসপ্রেমীদের অনেকেই মনে করেন, মাটির হাঁড়ির ঠাণ্ডাভাব পচন রোধ করে এবং রসের স্বাভাবিক স্বাদ ধরে রাখে। প্লাস্টিক বোতলে তেমনটা থাকে না। গরমে বা রোদে থাকলে বোতলের ভেতরের রস দ্রুত নষ্টও হয়ে যায়।
মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মিল্টন ত্রিপুরা জানান, “প্লাস্টিক সাধারণত একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি। বারবার ব্যবহার করলে বা তাপ পেলে বিসফেনল বা মাইক্রোপ্লাস্টিক বের হয়ে রসে মিশতে পারে। এতে পেটের সমস্যা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।” তাঁর মতে, খেজুর রস এমনিতেই খুব স্পর্শকাতর। সময়মতো না রাখলে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় দ্রুত। তাই পাত্রের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই পরিবর্তন শুধু স্বাদ, স্বাস্থ্যের বিষয়কেই প্রভাবিত করছে না; এর আঘাত লাগছে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও।
মাটিরাঙ্গা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কাজী মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ বললেন, “হাঁড়ি আর কলস বানানোর কারিগররা বেকার হয়ে পড়ছেন। তাদের শিল্পও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মাটির হাঁড়িতে যে স্বাদ পাওয়া যায়, তা কৃষক ভোক্তা সবাইকে সন্তুষ্ট করে। গ্রামের অর্থনীতিও বাঁচে।”
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, “যতদূর সম্ভব ঐতিহ্যবাহী মাটির কলসি কিংবা হাঁড়িতেই খেজুর রস রাখা উচিত। এটা শুধু স্বাস্থ্যসম্মতই নয়, রসের আসল মান-স্বাদ-ঘ্রাণও অটুট রাখে।
খেজুর রসের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় গাছ থেকে নামার প্রথম ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে। এরপর প্রাকৃতিক ফার্মেন্টেশন শুরু হয়। মাটির পাত্রে এই প্রক্রিয়া খুব ধীরে ঘটে, তাই মিষ্টতা ও স্বাভাবিক ঘ্রাণ দীর্ঘক্ষণ থাকে। কিন্তু প্লাস্টিক বোতলে অক্সিজেন বেশি থাকায় ফার্মেন্টেশন দ্রুত হয় মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যালকোহল বেড়ে গিয়ে স্বাদ পুরোপুরি বদলে যায়।
স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও আমাদের শীতের এই ঐতিহ্যবাহী পানীয়ের মান বজায় রাখতে নিরাপদ ও উপযুক্ত পাত্র ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তাদের মত একই দিকে সুবিধার জন্য প্লাস্টিক ব্যবহার ঠিক আছে, কিন্তু স্বাদ, নিরাপত্তা ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে মাটির হাঁড়ির বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি।
শীতের সকালের সেই টুপটাপ শব্দ, মাটির হাঁড়ির ঠাণ্ডা রস আর পিঠাঘ্রাণ—সব মিলিয়ে যে ছবি, তা শুধু খাবারের নয়; গ্রামীণ জীবনের এক অংশ। কিন্তু প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা ঐতিহ্যকে সরিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
খেজুর রসের স্বাদ ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি গ্রামের শিল্প–অর্থনীতি বাঁচাতে চাইলে হয়তো আবারও ফিরে তাকাতে হবে সেই পুরোনো মাটির হাঁড়ির দিকে।
দেখছি যা বলছি তা
https://dainikalokitopahar.com/