মাটিতে সোনা ফলানো কৃষক: খেজুর-ড্রাগনে নুর আলমের সাফল্য 

মো. আবুল হাসেম, স্টাফ রিপোর্টার
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার রসুলপুর এলাকার গ্রামীণ প্রান্তরে কৃষি উদ্যেক্তার জীবন এখন হয়ে উঠেছে অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। নুর আলম, যিনি প্রচলিত ফসলের বাইরে গিয়ে খেজুর ও ড্রাগন ফলের বাগানে সাফল্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সংগ্রাম ও অর্জন দেশের কৃষি ক্ষেত্রে নতুন আলো ঝলকাচ্ছে।

নুর আলমের খেজুর বাগানে চোখ যেকোনো দর্শকেরই মনোমুগ্ধকর। বর্ষা এলেই খেজুর গাছের ঝুলি ঝুলি ফল, আর রঙিন ড্রাগন ফলের ঝরে ঝরে সৌন্দর্য্য বাগানকে করে তোলে এক স্বপ্নরাজ্যে।

২০১৯ সালের গোড়ার দিকে, মাটিরাঙ্গা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা মেঠো পথ বেয়ে, রসুলপুর নামক এলাকায় গভীর অরণ্য ভেদ করে ১৩ একর জায়গা জুড়ে কয়েকখণ্ড জমিতে ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহপূর্বক ১০০টি টিস্যু কালচার খেজুরের চারা রোপন করেন তিনি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,

থোকায় থোকায় ঝুলছে মরুভূমির বিদেশি খেজুর। দেশের মাটিতে বাণিজ্যিক ভাবে মরুভূমির খেজুর চাষের খবরে প্রতিদিন তার বাগানে ভিড় করছেন স্থানীয়রা। একইসাথে একই জমিতে ড্রাগন সহ বিভিন্ন মিশ্র ফলের গাছ লাগিয়ে সফলতা পেয়েছেন তিনি।

নুর আলম বলেন, আমার বাগানে বারহি, মিটজল, আম্বার জাতের গাছে খেজুর এসেছে। গত বছর ২৫ টি খেজুর গাছে ফলন এসেছিল এ বছর ফলন বেড়ে ৭০ টি গাছে ফল আসছে। গত বছর ২ লাখের বেশি টাকা বিক্রি করা হলেও এবার ৫লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি জানান। বাগানে মোট ১০০টি খেজুরের গাছ আছে। আশাকরি আগামী বছর সবকটি গাছে ফলন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একইসাথে এই বাগানে খেজুরের টিস্যু কালচার বা শাখার চারা বিক্রি করা হবে বলে তিনি জানান। এ বছর ২১০ টি শাখার চারা বিক্রি করা যাবে।

এদিকে, একই জমিতে নুর আলম ড্রাগন চাষ শুরু করেন ২০২০ সালের জুন মাস থেকে। একই জমিতে ১৭শত পিলারে ড্রাগনের চাষ করেন তিনি। প্রতি পিলারে ৪টি গাছ লাগানো হয়েছে। বর্তমানে ৬হাজার ৮শত গাছের সবকটিতে ফলন এসেছে। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে সবকটি ড্রাগন গাছে ফলন আসছে।

ইতিমধ্যে ড্রাগন ফল হারভেস্ট শুরু হয়েছে। গত বছর প্রায় ৬লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করা হয়েছে। এ বছর ফলন কমে ৫লাখ টাকা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে চার প্রজাতির ড্রাগন চাষ করছেন তিনি। তার মধ্যে ইয়েলো, আমেরিকান বিউটি, তাইওয়ান রেড এবং থাই হোয়াইট।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে সারি সারি ড্রাগন ফুল ও বাহারি বর্ণের ফল। তবে দিনের দৃশ্য থেকে রাতের দৃশ্য আরো অপরুপ, চাঁদের আলোয় দেখে যেন মনে হয় বাগানে বিদ্যুতের আলো জ্বল জ্বল করছে।

এলাকাটি দূর্গম হবার দরুন বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সাড়ে ৬হাজার ওয়াটের সোলার সিস্টেম চালু করা রয়েছে। যা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা সম্পূর্ণ মিটে গেছে।

এদিকে চাইনিজ কমলা গাছ, রামভুটান, লংগান, লটকন, মিয়াজাকি আম, গুরুমতি, ভিয়েতনামি মাল্টা, কাটিমন আম, মিশরীয় মাল্টা, রিং মাল্টা, আলুবোখারা, আপেল, নাসপাতি, এ্যাভোকেটর সহ বিভিন্নজাতের ফলের গাছ রয়েছে এই বাগান টিতে।

গত বছর ১টন মাল্টা বিক্রি করা হয়। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার অধিক হবে বলে তিনি জানান।

তাছাড়া, গবেষণা বা পরিক্ষামূলক লাগানো হয়েছে ব্লাক আম্বর ও ঝাড় লেবু। আবহাওয়া ও মাটি উপযোগী হলে ব্যপকভাবে উৎপাদন করা হবে এ দুটি ফল।

খেজুর টা সম্পূর্ণভাবে আমদানি নির্ভর বিধায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে মূলত আমি খেজুর চাষ শুরু করি জানিয়ে কৃষি উদ্যেক্তা নুর আলম বলেন, আমদানি নির্ভর যেসব ফল রয়েছে সেসব যদি দেশে উৎপাদন করা হয় তাহলে আমদানি নির্ভরতা কমবে। হারভেস্ট করার পর যে ফল অন্তত ১৫ থেকে ১মাস পর্যন্ত ভাল থাকে সেসব ফল চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ুক। যেন আমরা সহজে বাজারজাত করতে পারি। এতে করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।

তিনি আরো বলেন, যারা খেজুরের চারা লাগাবেন তারা যেন বারহি জাতের খেজুর টা লাগান। বারহি জাতের খেজুর টা লাগানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা কাঁচা খাওয়া যায়। কাঁচা বাজাতজাত করা যায় নষ্ট হয় না। এই জাতের খেজুরে মিষ্টির পাশাপাশি ভাল ফলন হয়। খেজুরের চাষাবাদ থেকে ভালো ফল পাওয়ার জন্য কৃষকদের ধৈর্য ধরতে হবে, কারণ খেজুর বাড়তে একটু বেশি সময় লাগে।

জালাল আহাম্মদ বলেন, পাহাড়ের মাটিতে খেজুরের চাষ শুনে দেখতে এলাম। দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। নিজের জন্য স্বজনের জন্য কিনবো। বৈচিত্র্যময় সবুজ ও নান্দনিক পাহাড় বেশ সম্ভাবনাময় মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী এখানে সবুজ বিপ্লব সম্ভব।

মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক আব্দুল হামিদ বলেন, নুর আলমের উদ্ভাবনী প্রয়াস শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, তার মাধ্যমে মাটিরাঙ্গার কৃষি অর্থনীতি নতুন করে গড়ে উঠছে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির জনপ্রিয়তার ফলে এই অঞ্চল এক সময় দেশের অন্য অঞ্চলের জন্য এক মডেল হয়ে উঠবে।

মাটিরাঙ্গা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ চাকমা জানান, মাটিরাঙ্গা সৌদি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী, কারণ এর জলবায়ু অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের মতো। এছাড়া সৌদি জাতের খেজুর কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও বেশি প্রতিরোধী। নুর আলমের কৃষি সফলতার গল্প আমাদের শেখায়, সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মেলবন্ধনে মাটির সোনা ফলানো যায়।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, খেজুর একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল, এবং এটি আমাদের দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য হতে পারে। মাটিরাঙ্গা উপজেলার রসুলপুর এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে খেজুর চাষের বিষয়টি কৃষি বিভাগ অবগত আছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, সেখানে স্থাপিত বাগানের অবস্থা বেশ ভালো। অনেকগুলো গাছে ইতোমধ্যে ফলন এসেছে এবং পরিপক্বও হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এ ধরনের খেজুর চাষ সফলভাবে করতে হলে কৃষি বিভাগের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবং কারিগরি দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে চাষ করা প্রয়োজন। তাছাড়া কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকের পাশে আছে এবং থাকবে।