

সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিলাইছড়ি প্রতিনিধি-
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়নে প্রায় ৭০ টি গ্রাম এখনো বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে, নেই তেমন সড়ক যোগাযোগেও। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস এবং পাহাড় পর্বতে ঘেরা। মোট ইউনিয়নে মধ্যে সবচেয়ে জনসংখ্যায় বেশি ফারুয়া ইউনিয়ন । ফারুয়া ইউনিয়নে আয়তন ২৮০ বর্গকিলোমিটার এবং বড়থলি ইউনিয়নের আয়তন ২৭৮ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা অনুসারে এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী বেশি।
ডিজিটাল যুগে এসেও এখনো মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে রাঙামাটি বিলাইছড়ির ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়ন। ফারুয়া ৫০ টি এবং বড়থলি ২০ টি গ্রাম। দুই ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজারেও বেশি জনগণের বসবাস। মোবাইল ফোনে নেটওর্য়াক না থাকার ফলে ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। শুধু ফারুয়া ইউনিয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২১টি। বড়থলিতে ৪ টি। সেখানে মোবাইল নেটওর্য়াক না থাকার কারণে তারা যুগের সাথে তাল মেলাতে পারেনা । বর্তমানে সব কিছু ডিজিটাল আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, নাগরিক সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। যাতে প্রত্যেক নাগরিক খুব সহজে ঘরে বসে সেবা পায়। কিন্তু এই দুই ইউনিয়নের জনগণ এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সরেজমিনে দেখতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের সব চেয়ে বড় ইউনিয়ন এই ফারুয়া ইউনিয়ন। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ এখানে বসবাস করছে। একইভাবে ফারুয়ার দক্ষিণে মায়ানমার ও ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় ৪০০০ জনসংখ্যা রয়েছে বড়তলি ইউনিয়নেও। এখানে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষদের দেখলে মনে হওয়ার কোনো অবকাশ নেই যে এরা বাংলাদেশের জনগণ। একেতো দুর্গম আর পশ্চাৎপদ এলাকা, অন্য দিকে মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ফলে দেখা যায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কৃষক তার ফসলি জমির যেকোনো সমস্যায় কৃষি বিশেষজ্ঞ কিংবা কৃষিসম্প্রসারণ কর্মকর্তার পরামর্শ পান না। সেক্ষেত্রে তাকে উপজেলা সদরে আসতে হয়।
দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, মোবাইল ফোন, ইন্টারেনট সেবা এখন পৌ্ছেঁ গেছে ঘরে ঘরে। অথচ কাল্পনিক মনে হলেও বাস্তব সত্য যে ফারুয়া ও বড় থলি এই দুই ইউনিয়নে মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতির সময় সারা দেশে প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে। এখানকার শিশুরা এই সেবা নেটওয়ার্ক থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় অভিভাবকদের দাবী, তাদের সন্তানরা যেন জরুরি নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ এই সুবিধাটি পায়। এছাড়া প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নেই মোবাইল নেটওয়ার্কের সুবিধা। সারা বাংলাদেশের মানুষ যেখানে ঘরে বসে ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে এসব এলাকার ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনসাধারণ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
কৃষক / জুমিয়ারা জানান, জুম ও জমিতে উৎপাদিত ফলমূল ও শাকসব্জি এবং মসলা জাতীয় পণ্য আদা,হলুদ দেশে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বিদ্যুৎ, নেটওয়ার্ক ও মূল সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধা না হওয়ায় ঠিকমত ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংরক্ষণ এবং বাজারজাত করা যাচ্ছে না। যার ফলে নার্য্যমূল্য পাচ্ছি না, কোনো কোনো সময় পঁচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, সরকার চাইলে যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে, এজন্য দরকার সকল প্রশাসনের সদিচ্ছা। অনেক কষ্টের মধ্যে আছি আমরা। এখানে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও মোবাইলে নেটওয়ার্ক নাই। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পাওয়া এগুলো সব মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো পাইও না জানেও না। অসুস্থ রোগীদের জন্য ঠিক মতো চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা নাই। অভিজ্ঞ ডাক্তারদের যে পরামর্শ নেব সেই সুযোগও নাই। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক না থাকায় আমরা সরকারের নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তারা জানান, মনে হয় আমরা এদেশের জনগণ নই।সেজন্য সরকার আমাদের দেখতে পারে না।সরকার চাইলে এটা সমাধান করতে পারেন। এ বিষয়ে নেই কোনো সরকার ও কোনো প্রশাসনের সদিচ্ছা। এজন্য প্রয়োজন উপজেলা ও জেলার সকল প্রশাসন ও পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সুদৃষ্টি।
বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক জানান, নেটওয়ার্কের যতো ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা আছে তা আমরা পাচ্ছি না। বিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কাজগুলো আমাদের বিলাইছড়ি অথবা পার্শ্ববর্তী উপজেলা রাজস্থলী এবং বান্দরবানে রুমা উপজেলায় গিয়ে করতে হয়। যা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। আমাদের নেটওয়ার্কের অসুবিধার কারণে এইসব যেতে হচ্ছে।
এলাকার হেডম্যানরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে । দেশে প্রায় জায়গায় সড়ক, নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ সুবিধা উন্নতি করা হচ্ছে, করা হচ্ছে না আমাদের ইউনিয়নগুলো। স্বাধীনতার আগ থেকেই এই গ্রামগুলোতে বসবাস করে আসছে মানুষ। সরকার দেখেও না দেখার মতো রয়েছে।
ধর্মীয় গুরু/ পালক প্রধান রবার্ট বম জানান,উপজেলা ও শহরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সবসয় রঙিন আলোতে ঝলমল করে। সেখানে গেলে রঙিন জগতে বসবাস করছে মনে হয়, কিন্তু নিজের জায়গায় আসলে মনে হয় ভিন্ন জগতে বসবাস করছি। আর ফারুয়ার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ডুকলে টর্চের আলো দিয়ে ডুকতে হয়। নেটওয়ার্ক তো নাই,নাই বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের কথা না হয় বাদ দিলাম।
ওয়ার্ড মেম্বাররা জানান, মোবাইল নেটওর্য়াক না থাকায় এলাকায় বড় সমস্যা। বন্যা, ও মহামারী হলে অনেক সময় সরকারের মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওয়ার্ড গুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু এলাকা মোটর বাইকে যেতে পারলেও বেশির ভাগ এলাকায় যেতে হয় পায়ে হেঁটে। যেকোন মুহূর্তে বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশংকা সবসময় সকলের মধ্যে। তবুও জনগণের জন্য কাজ করে যেতে হচ্ছে।
বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া থেকে যোগাযোগের পথ বর্তমানে পাশ্বর্বতী উপজেলা রাজস্থলীর সাথে কিছুটা সুব্যবস্থা হলেও, উন্নতি করা হয়নি ফারুয়ার সাথে উপজেলা সদর পর্যন্ত। স্বাধীনতার পর থেকে সড়ক পথ করা হয়নি ফারুয়া হতে বড়থলি পর্যন্ত ও। এখানকার যাতায়াতে ফারুয়া ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুটা সড়ক পথ থাকলেও নেই কোনো বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কের সুবিধা। যার ফলে চরম বিপাকে ফারুয়া ও বড়থলিবাসী।
ফারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, ১৯৮৪ সালে ইউনিয়নটি উন্নিত করা হলেও এখনো নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ সংযোগ করা হয়নি। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শতভাগ করার জন্য সরকার থেকে নির্দেশনা আসে কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে আমার এই জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনটি সঠিকভাবে করতে পারছিনা। প্রতিবন্ধীভাতা, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পেমেন্ট করা হয়। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে এদের ভাতা ঠিক মতো পায় না।
তিনি বলেন, এ ইউনিয়নটি অতি দুর্গম হওয়াতে অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে উন্নয়নে পিছিয়ে আছে, মোবাইল ফোনে নেটওর্য়াক না থাকার কারণে সহজে যোগাযোগ করা যায় না। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে ফারুয়া ইউনিয়নের সেবাদানের লক্ষ্যে সরকার যাতে মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্কের টাওয়ার স্থাপন এবং বিদ্যুৎ সুবিধা করে দেয় সেজন্য ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে ইউনিয়ন বাসীর পক্ষ থেকে জোড়দাবী জানিয়েছেন।
বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জামাইয়া তঞ্চঙ্গ্যা জানান, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় দুর্গম ইউনিয়ন হচ্ছে বড়থলি ইউনিয়ন। ২০১৩ সালে ৪ নভেম্বর ফারুয়ার ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডকে আলাদা করে বড়থলি ইউনিয়নে উন্নিত করা হয়। ইউনিয়নটি উন্নিত হলেও এখনও ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় নাই। মোবাইলে নেটওয়ার্ক তো দুরের কথা। ইউনিয়নটি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কাছাকাছি হওয়ায় বড়থলি সীমান্তে রুমা উপজেলার কাছাকাছি এলাকায় একটি অস্থায়ী কার্যালয়ে অফিস পরিচালনা করছি। হাইস্কুল ১ টি রয়েছে, রয়েছে ৯ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। মোবাইলে নেটওয়ার্ক কথা বাদ দিলাম, উপজেলায় অফিসিয়াল কাজে আসতে হলে আসতে হয় রুমা, বান্দর বান, রাজস্থলী ও কাপ্তাই উপজেলা হয়ে। যা প্রায় ২ দিন সময় লাগে। আর বড়থলি থেকে ফারুয়ার পথে কোনো সড়ক পথ নেই। হেঁটে আসলে প্রায় ১ সপ্তাহ সময় লাগে। বিদ্যুৎতের কথা বাদ দিলাম। তাই বিদ্যালয়গুলো নেটওয়ার্কের আওতায় এনে দ্রুত জাতীয়করণ করা প্রয়োজন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুরজিত দত্ত জানান, ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়নে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো ঔষধ সরবরাহ করা খুবই কঠিন হচ্ছে । গর্ভবতী মা এবং শিশুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে করা যাচ্ছে না। রেজিষ্ট্রেশন, টিকা ও মেডিকেল ক্যাম্প সঠিকভাবে পরিচালনায় ব্যাহত হচ্ছে। বর্ষাকালে বন্যার পরে বিশুদ্ধ পানি না থাকার কারণে ডায়রিয়া, গ্রীষ্মকালে কলেরা সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় এতে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছাতে নিয়মিত ব্যাহত হচ্ছে । ইউনিয়নগুলো দুর্গম হওয়ায় কোনো কোনো সময় ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছার আগেই রোগী মারা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, দুর্গম এলাকায় মোবাইল নেটওর্য়াক পৌছে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ই-লার্নিং ও আধুনিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১০০টি বিদ্যালয়ে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকার। এ উদ্যোগ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত এক বিপ্লব হবে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে শহরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাসে অংশ নিতে পারবে। ডিজিটাল যুগের থেকে পিছিয়ে পড়ছে এ এলাকার জনগণ তাই জনজীবনে অতিব গুরুত্বপূর্ণ এই ডিজিটাল সেবা মোবাইল ফোন নেটওর্য়াক, বিদ্যুৎ ও সংযোগ সড়ক পথ চালুর দাবি জানিয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী।