সাড়ে তিন মাসে রাজস্ব আয় ১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকাকাপ্তাই হ্রদের মাছ; কদর বাড়ছে দেশ-বিদেশে

॥মোঃ নুরুল আমিন, স্টাফ রিপোর্টার, রাঙ্গামাটি॥
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলধারা ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্র রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ। যা দেশের মিঠা পানির মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। সারাদেশে কমবেশি মাছ উৎপাদন হলেও দেশজুড়ে আলাদা কদর রয়েছে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদের উৎপাদিত মাছের। কারণ, এ মাছ উৎপাদিত হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে। যা স্বাদে-গন্ধে অনন্য এ মাছ মিশে আছে রাঙ্গামাটির ঐতিহ্যের সঙ্গে। দীর্ঘ তিন মাছ কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণ বন্ধ থাকার পর পুরোদমে চলছে মাছ আহরণ। এতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। বর্তমানে হ্রদের মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ৯৫ শতাংশ দখল করে আছে ছোট মাছ- বিশেষ করে কাচকি ও চাপিলা। উৎপাদিত মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। কাপ্তাই হ্রদের মাছ অর্থনীতির বড় একটি চালিকা শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকায় তা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে।

জানা গেছে, মাসুদ ফিশ, সীমার্ক, বিডিফুড,ও আনরাজ ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন মৎস্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে কাচকি ও চাপিলা সংগ্রহ করছে। আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এসব মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে আরব আমিরাত, লন্ডনসহ বিশ্বের নানা দেশে। এসব দেশে বেশ কদর রয়েছে কাপ্তাই হ্রদের মাছের।

রাঙ্গামাটি বিএফডিসি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের আগস্ট-নভেম্বর মাসের ১৫তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ বিগত সাড়ে তিন মাসে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৫ হাজার ৮২৫ মেট্রিক টন মাছ আহরিত হয়েছে। এ থেকে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন রাজস্ব আয় হয়েছে ১৩ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা । যা অতীতের চেয়ে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড। বিগত দুই অর্থ বছরের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সাড়ে তিন মাসে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৫ হাজার ৫৩৭ মেট্রিক টন মাছ আহরিত হয়েছিল। রাজস্ব আয় হয়েছিল ১১ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা। গত অর্থ বছরের চেয়ে এছর ২৮৮ মেট্রিক টন মাছ বেশি আহরিত হয়েছে। এছড়াও রাজস্বও ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বেশি আদায় হয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য ব্যবসায়ী খোকন বড়ুয়া জানান, এই হ্রদটি হচ্ছে প্রকৃতির উপর নির্ভর। এখানে পর্যাপ্ত পানি থাকলে মাছের উৎপাদন খুব ভালো হয়। হ্রদে বিগত বর্ষা মৌসুমে পানি বৃদ্ধি হওয়ায় মাছের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি হয়েছে তেমনি তাদের ব্যবসাও ভালো হয়েছে। তিনি আরো জানান, বিদেশে রপ্তানিযোগ্য মাছের জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাঙ্গামাটিতে প্রসেসিং ফ্যাক্টরি স্থাপন করা গেলে কর্মসংস্থান বাড়বে, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন এবং আঞ্চলিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

রাঙ্গামাটির মাছ ব্যবসায়ী মনি ত্রিপুরা বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি যদি সবসময় থাকে তাহলে হ্রদে মাছ উৎপাদনও ভালো হবে। এতে করে ব্যবসয়ীদের আয়-রোজগার বাড়বে।

মাছ ব্যবসায়ী উদয়ন বড়ুয়া জানান, কাপ্তাই হ্রদের মাছের বিদেশমুখী বাণিজ্য ইতোমধ্যেই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু রাঙ্গমাটি থেকেই প্রতিদিন প্রায় তিন মেট্রিক টন মাছ বিদেশে রপ্তানির জন্য পাঠানো হয়, যার স্থানীয় বাজার মূল্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা। জেলেদের ধরা মাছ প্রথমে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন ঘাটে রাজস্ব দিয়ে বাছাই ও বরফে প্যাকিং করা হয়। এরপর তা চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় যায় এবং সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে রপ্তানি হয়।

মাছ ব্যবসায়ী মোঃ বুলবুল জানান, এক সময় বড় মাছ (কার্প জাতীয়) বেশি পাওয়া যেত। তবে হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। ফলে ছোট মাছের আধিক্য বেড়েছে। তবে ছোট মাছ বিদেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং বাণিজ্য বাড়ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি অঞ্চলের হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে.কমান্ডার ফয়েজ আল করিম জানান, কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য উৎপাদন প্রতিবছরই ক্রমন্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিএফডিসি অবৈধ জাল, চোরাচালন এবং মাছের সঠিক সাইজের প্রতি নজরদারি বাড়িয়েছে। এর ফল স্বরূপ এ বছরের সাড়ে তিন মাসে যে মাছ অবতরণ হয়েছে,গত বছর তার চেয়েও কম ছিল। তিনি আশাবাদী গত অর্থ বছরের তুলনায় এবছর মৎস্য আহরণ অনেক বেশি হবে। তিনি আরো জানান, কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরিত হচ্ছে ৯৫ শতাংশ কাচকি ও চাপিলা মাছ। এই মাছগুলো বেশ পুষ্টি ও স্বাদে ভরা এবং বাজারে অন্যান্য মাছের তুলনায় দাম কম হওয়ায় এই মাছে আধিক্যতা এবং বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে এই মাছগুলো দেশ-বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। এরপর পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায় এবং এ হ্রদের সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে চাকমা রাজবাড়ীসহ হাজার হাজার পরিবার উদ্ধাস্তু হলেও সৃষ্টি হয় মাছের বড় বানিজ্যিক কেন্দ্র, উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। বানিজ্যিভাবে মাছের দিন দিন উন্নয়ন, সাথে হ্রদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার সুফল ভোগ করছেন এ অঞ্চলের ২৬ হাজারেরও অধিক মৎস্যজীবী। অর্থনীতির বড় একটি চালিকা শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকায় তা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে।

পহেলা মে দেশের সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন, পোনা মাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণসহ কাপ্তাই হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে তিন মাসের জন্য হ্রদ হতে সকল প্রকার মৎস্য আহরণ, বাজারজাতকরণ এবং পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, বিএফডিসি ও রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন। এরপর ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।