

লেখক- মো. সহিদুল ইসলাম সুমন
নতুন বছরকে বরণ ও পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে পাহাড়ে বসবাসরত বাংগালি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠেী প্রতিবছর নববর্ষ ও ‘বৈসাবি’ উৎসব সুদীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে।পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সকল সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব নববর্ষ উৎযাপন। যা বাঙালিদের কাছে বাংলা নববর্ষ, চাকমাদের বিজু,মারমা সম্প্রদায়ের কাছে সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কাছে বৈসু নামে পরিচিত। তবে যে যে নামেই পালন করুক না কেন এটি পাহাড়ের প্রধান উৎসব।পাহাড়ের প্রধান তিন সম্প্রদায় একসাথে তাদের বৈসাবি নামটি তিনটি জনগোষ্ঠীর উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে। চাকমাদের ‘বিঝু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ ও ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’-এই তিন উৎসব সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’। ।এই উৎসবকে ঘিরে সব সম্প্রদায়ের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মেলবন্ধন ঘটে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১০ ভাষাভাষির ১১ ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী মধ্যে বৈসাবি কে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে উৎসবের রং লাগে, বর্ণিল সাজে সাজানো হয় পাহাড়। ঘরে ঘরে আনন্দের ধ্বনি,বসে আনন্দ উল্লাস আর নাচ-গানের আসর। পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনের উৎসব বৈসাবিকে ঘিরে নতুন সাজে সাজে পাহাড়ি জনপদ । পাহাড়ি তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, জায়া-জননীরা মিলেমিশে প্রাণের এই উৎসবে অংশ নেয়।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের অভিমত থেকে জানা যায় সম্রাট আকবরই ফসলী সন হিসেবে বাংলা সন চালু করেছিলেন এবং সম্রাট আকবর যা চেয়েছিলেন তা হলো রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করা।
আর তার এই প্রয়াসের মধ্য দিয়েই বাংলা সনের উদ্ভব হয়েছিল। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন হিজরী সন ছিল ৯৬৩ এবং বাংলা সনও ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
দেশ শাসনের ২৯তম বছরে হিজরী ৯৯২ সালে তিনি পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। বাংলা ছিলো কৃষি প্রধান, ফলে খাজনা দেয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসেব করতে সমস্যা হতো।এ কারণেই সম্রাট আকবর তখন বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন, পহেলা বৈশাখ দিয়ে যার শুরু।তখন কর দেয়ার সময়ে ফসল উঠতো না। ফলে কৃষকদের কর দিতে সমস্যা হতো। সে কারণেই সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখের প্রথা প্রচলন করেন। আগে বাংলায় বছরের শুরু হতো অগ্রহায়ণ দিয়ে, কারণ তখন কৃষকের ঘরে ফসল আসতো।কিন্তু খাজনা আদায়সহ নানা কিছু চিন্তা করেই বাংলা সন পহেলা বৈশাখ থেকে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলা নববর্ষের আরেকটি ঐতিহ্য হলো হালখাতা, হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া।বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ঐ বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়।এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে “হালখাতা”-র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি এখনও পালন করা হয়ে থাকে।
আর বৈসাবির শিকড় মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়া এসব দেশগুলোতে একই সময়ে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়-যা ‘সংক্রান’ নামে পরিচিত। ধারণা করা হচ্ছে, শত শত বছর আগে আরাকান ও বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে মারমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার সময় তাদের সাংগ্রাই উৎসব সঙ্গে নিয়ে আসে। একইভাবে চাকমা ও ত্রিপুরাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসবও ধীরে ধীরে একসঙ্গে মিলিত হয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ হয়েছে।
বিঝু চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়।১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিজু। এই দিন ভোরের আলো ফুটার আগেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। সংগ্রহিত ফুলের একভাগ দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয় আর অন্যভাগ জলেতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মুলবিজু। এইদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি স্নান করিয়ে পূজা করা হয়। ছেলেমেয়েরা তাদের বৃদ্ধ ঠাকুরদা-ঠাকুমা এবং দাদু-দিদাকে স্নান করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। এই দিনে ঘরে ঘরে পোলাও পায়েস পাচন (বিভিন্ন রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের তরকারি) সহ অনেক ধরনের সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়। বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজন বেড়াতে আসে ঘরে ঘরে এবং এসব খাবার দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করা হয়। সারাদিন রাত ধরে চলে ঘুরাঘুরি। বাংলা নববর্ষের ১ম দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় গজ্যা পজ্যা দিন (গড়িয়ে পড়ার দিন)। এই দিনেও বিজুর আমেজ থাকে।
মারমা সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত। মূলত ‘সাক্রাই’ (সাল) শব্দ থেকেই ‘সাংগ্রাই’ শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলায় ‘সংক্রান্তি’ বলে পরিচিত। মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই জ্যা’র (মারমা বর্ষপঞ্জি) গঠনের মাধ্যমে সাংগ্রাইয়ের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। মাইংমা ১৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দের আগে থেকেই এ ‘সাক্রাই’ বা সাল গণনা করা হয়, যা ‘জ্যা সাক্রই’ নামে পরিচিত।সাংগ্রাই বাংলাদেশী মারমা এবং রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসবের নাম, যা প্রতিবছর এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখে পালিত হয়।যদিও এটি মারমাদের অন্যতম প্রধান একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, তবে রাখাইনরাও নিজস্ব নিয়মে সাংগ্রাইয়ের মাধ্যমে বর্ষবরণ করে নেয়। মারমাদের ক্ষেত্রে তাদের বর্মী বর্ষপঞ্জি অনুসরারেই এটি পালিত হয়। মারমাদের বর্ষপঞ্জিকাকে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” বলা হয়। “ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন কে মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। আগে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” অনুযায়ী এই তিনদিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে পড়লেও এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সাথে মিল রেখে এপ্রিলের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করা হয়। ১৩ তারিখের সকালে পাঃংছোয়াই (ফুল সাংগ্রাই), ১৪ তারিখে প্রধান সাংগ্রাই আর ১৫ তারিখে পানি খেলার সাথে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিন দিনব্যাপী পালিত হয় বৈসু। ত্রিপুরাদের এই উৎসবের প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কতাল। মূলত আগামি দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করা হয়ে থাকে এই দিনে। তিন দিনব্যাপী এই বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। হারি বৈসুতে ভোরবেলায় ফুলগাছ থেকে ফুল তোলার হিড়িক পড়ে যায়। সেই ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজানো ও মন্তির ও পবিত্র স্থানগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বৈসাবি উৎসবের জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’ রান্না চলবে ত্রিপুরাদের প্রায় ঘরে ঘরে। এছাড়া পিঠা, সেমাই, মুড়ি-মুড়কি, চানাচুর,বিভিন্ন ধরনের ফল ও ঠান্ডা পানীয় তো থাকছেই। ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির মিশ্রণে রান্না করা হয় বিশেষ সবজি।ত্রিপুরা ও মারমাদের পানি উৎসব প্রায় কমবেশি অনেকের কাছে জনপ্রিয়। এটি বৈসাবি উৎসবেরই একটি অংশ। এই উৎসবে সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন, যেন গত বছরের সকল দুঃখ, গ্লানি ও পাপ ধুয়ে যায়। এরআগে হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রিয় মানুষটির দিকে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালবাসা প্রকাশ করা হয়। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস ও বর্ণাঢ্য অনুভূতি ‘গান্ধর্ব্য’ কেবল বৈসাবি উৎসবেই শোভা পায়।
বান্দরবানের তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিষু উৎসব পালন করে থাকে। এদিন সাংগু নদীতে কলাপাতায় ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর পূজা করে থাকেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ। বিষু উৎসবে ঘিলা খেলার মাধ্যমে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিষু উৎসব শুরু হয়। তারপর ২০ থেকে ৩০ পদের সবজি দিয়ে তাদের তৈরি ঐতিহ্যবাহী পাচন ভোজন সম্পন্ন করে।
পাহাড়ের লোক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচিতি চৈত্র সংক্রান্তির এসব উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, পিঠা উৎসব, জলকেলি উৎসব, হরেক রকমের বাহারি পোশাক পরিচ্ছদ, লোকনৃত্য পরিবেশন, গান, বাদ্য, পাজন খাওয়ার ধুম সবকিছুই উৎসুক জনতার চোখকে রাঙিয়ে ও ধাঁধিয়ে দেয়, এবারের পাহাড়ি চৈত্র সংক্রান্তির বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, চাংক্রান, বিহু উৎসবগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মেল বন্ধন ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার অংগীকার হোক এই প্রত্যাশা করছি। শুভ নববর্ষ।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সদস্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ।