লামায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দ্বিগুন রোগীর চাপ, ঠাঁই হচ্ছে মেঝে-বারান্দায়

মো. ইসমাইলুল করিম, প্রতিনিধি:
পার্বত্য জেলার বান্দরবানের সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লামা উপজেলা এ উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী মিলে প্রায় ৩ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে বেশির ভাগই শ্রমজীবি। এসব মানুষের একসমাত্র চিকিৎসা সেবায় রয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্র ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। ভৌগোলিক কারণে চকরিয়া উপজেলার ছিটমহল খ্যাত বমুবিলছড়ি ইউনিয়ন ও আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের বাসিন্দারাও এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভরশীল। জ্বর-সর্দি থেকে শুরু করে নানা জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শত শত রোগী এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই চিকিৎসা নেন। কিন্তু রোগীর তুলনায় নার্স সংকট না থাকলেও চিকিৎসক ও বেড সংকট থাকায় রোগীদের চিকিৎসা সেবায় দারুণ ব্যাঘাত ঘটছে। বেড সংকুলন না হওয়ায় বারান্দায় ও মেঝেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ, কোথাও তিল পরিমাণ ঠাঁই ন্ইে। এছাড়া ভর্তির চারদিন পার হলেও রোগীরা পায়না খাবার। এতে প্রায়ই রোগীর স্বজনদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় চিকিৎসক ও নার্সদের। প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বিবেচনায় -এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ১০০ শয্যায় উন্নতি করণের দাবি তুলেছেন চিকিৎসকসহ তিন উপজেলার ৯ ইউনিয়ন ও পৌরসভাবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ২০০৯ সালে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় লামা উপাজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে। এরপর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আরো বেশি বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা।

লামা উপজেলা, পাশের বমুবিলছড়ি ও চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে ৮৫ ভাগই শ্রমজীবি। উপজেলার বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মত সামর্থ তাদের নেই। তাই বাধ্য হয়ে জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসা নেন এখানের বাসিন্দারা। প্রতিদিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯০ থেকে ১০০ শয্যার বেশি রোগীর সেবা দিতে হয়। বহিবিভাগে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত রোগী নিচ্ছেন চিকিৎসা। যোগদানের পর থেকে রোগীদের সু-চিকিৎসায় বিদুৎ এর বিকল্পসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন বর্তমানে কর্মরত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২৩ চিকিৎসকের পদ থাকলেও এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ কর্মরত আছেন মাত্র ৬ জন। এর মধ্যে আবার জুনিয়র কনসাল্টেন্ট (শিশু) দুই জনের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও আরেক মেডিকেল অফিসার বান্দরবান সদর হাসপাতালে প্রেষণে রয়েছে, এখন রয়েছেন মাত্র ৩জন চিকিৎসক। গাইনি ও ডেন্টাল চিকিৎসক নেই দীর্ঘদিন ধরে। জুনিয়র মেকানিক (বিদ্যুৎ) কাগজে কলমে থাকলেও তিনিও বান্দরবান সদর হাসপাতালে প্রেষণে। এম্ব্যলেন্স ড্রাইভার নেই দীর্ঘদিন ধরে। মাস্টার রোলে নিয়োগের মাধ্যমে একজন ড্রাইভার দিয়ে কোনমতে পুরাতন এম্বুলেন্স দুটি জোড়াতালিতে চলছে। ওয়ার্ড বয় থাকার কথা ৩ জন, আছেন ১ জন। পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকার কথা ৫ জন, আছেন ৩ জন। তার মধ্যে একজন প্রেষণে বান্দরবান সদর হাসপাতালে। নিরাপত্তা প্রহরী থাকার কথা ২ জন, কিন্তু আছেন ১ জন। এছাড়া অফিস সহায়ক থাকার কথা ৪ জন, আছেন ১ জন। মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট থাকার কথা ২ জন, আছেন ১ জন। এসব সংকটের কারণে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে বেড সংকটের কারণে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্সসহ সব ধরণের সংকট চলে আসছিল। অনেক চিঠি চালাচালির পর গতমাসে ১৯ নার্সকে পোষ্টিং দেওয়া হয়। এতে নার্স সংকট কাটলেও সংকট কাটেনি শয্যা, চিকিৎসক ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর। সরকারি এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর ভরসা লামা উপজেলাসহ আশপাশের দুই ইউনিয়ন বাসিন্দাদের। ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকে ৯০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত। কখনো কখনো আবার এ সংখ্যা বেড়ে ১২০জন পর্যন্ত দাঁড়ায়। এদিকে গত তিন মাসে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ হাজার ৭৮৫জন। বহিবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন গত পাঁচ দিনে সাড়ে ১২শ রোগী।সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়- বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইন, আন্তঃবিভাগে শয্যা না পেয়ে রোগীরা মেঝে ও বারান্দায় ভর্তি। এক সিটে দুইজনও ভর্তির দেওয়া হয়েছে। এনসিডি কর্নারেও শতাধিক রোগী উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছেন।

কথা হয় আন্তবিভাগে দায়িত্বরত নার্সিং সুপার ভাইজার নিলীমা রানী দে’র সাথে। তিনি বলেন, আমরা ৬জন নার্স ডিউিিটতে আছি। রোগির পরিমান এতই বেশি যে, আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে শুধু -এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্তবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ শতাধিক রোগী। এতে গড়ে শিশু রোগীর সংখ্যা রয়েছে ২৪-২৫জন। অথচ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড রয়েছে ৫০টি। তাই ভর্তির চার দিন পরেও ৪০-৫০ রোগী খাবার পায় না। মেঝে ও বারান্দায় ভর্তি দিতে হচ্ছে। রোগীদের। খাবার ও বেড নিয়ে প্রায় সময় রোগীর স্বজনদের তোপের মুখে পড়েন নার্সরা। এত সংকটে থাকার পরেও নার্সরা সেবার মান বজায় রাখতে আমরা অনড়। রোগী অভিভাবক বলেন, গত ২৬ অক্টোবর সকালে আমার ছেলে চাকলাউর উঠলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসি। আমাদের বাড়ি ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি মিরিঞ্জা বাগান বাড়ি এলাকায়। কিন্তু বেড় খালি না থাকায় মেঝেতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তাছাড়া ভর্তির চার দিন পার হয়ে গেলেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কোন খাবার পাচ্ছিনা। হোটেল থেকে কিনে খাওয়ার মত সমর্থও আমাদের নেই। একই কথা জানান দুর্গম পাহাড়ি চিউনী এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী মাবু মার্মার স্বামী উচিং মার্মা। পাশের চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়ন থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী তাসমিয়া তাহমিদ’র বাবা মো. ইলিয়াছ জানায়, জ¦র উঠলে মেয়েকে লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেলেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কোন ধরণের পথ্য বা খাবার পাচ্ছিনা, বাহির থেকে কিনে খেতে হচ্ছে।রোগীর স্বজন দিদারুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মংছিং মার্মাসহ অনেকের অভিযোগ, যতই শীত বাড়ছে, ততই ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সে অনুপাতে বেড নেই। নেই চিকিৎসকও। এ শীতের মধ্যে বারান্দায় বা ফ্লোরে থেকে ছোট-ছোট শিশুদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এতে করে রোগীর সঙ্গে স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বেডের তুলনায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা নাদিম বলেন, লামা ৫০ শয্যা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি রোগী আন্তবিভাগে ভর্তি থাকেন। দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দ্রুত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা অতিব জরুরী। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলে রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবাসহ খাবারের আভিযোগ আর থাকবেন। তিনি আরও বলেন, ‘সীমিত জনবল নিয়ে বৃহৎ পরিসরে চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। আমি যোগদানের পরপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গড়ে রোগী ভর্তির পরিস্থিতি দেখে দ্রুত ১০০ শয্যা চালুস চিকিৎসকসহ জনবল নিয়োগের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও চিঠি প্রেরণ করি, কিন্তু কাজ হয়নি। বর্তমান হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই ভবন নির্মাণ করে বাড়তি রোগীর সেবা দেয়া সম্ভব।